ভগবান মহাবীর
"জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে, সে জাতির নাম মানুষ জাতি।
এক ই পৃথিবীর অন্নে লালিত, এক ই রবি শশী মোদের সাথী"
বাংলা ভাষার এইটি একটি প্রসিদ্ধ কবিতা। ভগবান মহাবীর কিন্তু আর ও আগে চলে গিয়েছিলেন। তিনি বললেন শুধু মানুষ নয় সমস্ত জীবজগত ই সম্মিলিত রূপে এক ই জাতি। তিনি জৈন আগম
'স্থানাংগ সূত্রে' উদাত্ত স্বরে ঘোষণা করলেন
"এগে আয়া" অর্থাৎ সমস্ত জীব জগৎ এক. বসুধৈব কুটুম্বকমের এই অবধারণা ই মহাবীর কে অন্য্ সমস্ত মহাপুরুষদের থেকে ভিন্ন করে, এবং তাকে সর্বশ্রেষ্ঠ রূপে প্রস্তুত করে.
মহাবীরের অন্য্ একটা বিশেষত্ব নিয়ে চর্চা না করলে সেই মহাপুরুষকে ঠিক মত্ বোঝা যাবে না. কেবল জ্ঞান প্রাপ্তির পর তিনি সর্বজ্ঞ হলেন, তারপর উপদেশ প্রারম্ভ করলেন। তিনি যখন তার প্রথম উপদেশ দিলেন তখন কিন্তু সেটা নিজের নাম শুরু করেন নি. তিনি কখন ই বলেন নি যে তিনি কোনো নতুন ধর্ম প্রবর্তন করছেন। তিনি বললেন, আমার আগে অনন্ত অর্হৎ বা তীর্থঙ্কর হয়েছেন এবং ভবিষ্যতে ও হবেন। তারা সবাই এই বলেছেন, এবং ভবিষ্যতে বলবেন যে জেব মাত্রের হিংসা না করা অর্থাৎ
অহিংসা ই একমাত্র ধর্ম। তিনি যে ধর্মের কথা বলছেন সেটা কিন্তু নতুন কিছু নয়, সেটা একটা নিত্য, সনাতন প্রবাহ। যেমন নদির প্রবাহ মাঝে মাঝে অবরুদ্ধ হয়ে যায়, এবং কোনো বিশিষ্ট শক্তিশালী মানুষ সেই প্রবাহ কে আবার খুলে দেয় ঠিক সেই ভাবে ধর্মের প্রবাহ অবরুদ্ধ হলে, তার মধ্যে বিকৃতি এলে তীর্থঙ্কর জন্ম নেন এবং ধর্মের সেই চিরন্তন স্রোত কে পুনরায় গতি প্রদান করেন, ধর্ম রূপ গঙ্গা কে স্বচ্ছ করেন। মহাবীর দ্বারা উপদেশিত জৈন ধর্ম, যার প্রাচীন নাম অর্হৎ বা নির্গ্রন্থ ধর্ম, এই ধর্মে ব্যক্তি পূজার কোনো স্থান নেই.
কেবল মাত্র এই কালখন্ডে, জৈন পরিভাষায় যাকে 'অবসর্পিনী কাল' বলা হয়, ঋষভদেব থেকে প্রারম্ভ করেপার্শ্বনাথ যেতাম মহাবীর পর্য্যন্ত ২৪ জন তীর্থঙ্কর হয়েছেন, তারা সবাই যা বলেছেন তাই জৈন ধর্ম। মহাবীর তাদের থেকে ভিন্ন কিছু বলেন নি, মাত্র কাল সাপেক্ষে তার ব্যাখ্যা করেছেন।
.jpg) |
ভগবান মহাবীর |
 |
মহাবীর স্বামী মন্দির, কোলকাতা |
জাতি প্রথার বিরোধ মহাবীরের অন্যতম অবদান। মহাবীরের সময় বৈদিক ধর্মের এক বিকৃত রূপ সামনে এসেছিল, যার ফলে শূদ্রের উপর প্রচন্ড নির্যাতন হতো. জন্ম থেকে নির্ধারিত হতো জাতি, এবং মানুষের নিজের কোনো স্বাধীনতা ছিল না. মহাবীরের উপদেশ সেই সময়ে শূদ্র এবং তথাকথিত নীচে জাতির জন্য সঞ্জীবনী হয়েছিল। তিনি জন্ম থেকে নয় কিন্তু কর্ম থেকে জাতি স্বীকার করেন। ভগবান মহাবীর ঘোষণা করলেন
"কম্মনা বম্ভনো হোই, কম্মুনা হোই ক্ষত্তিয়ো,
কম্মনা বৈশ্য হোই, সুদ্দো হোই কম্মুনা"
অর্থাৎ কর্ম থেকে মানুষ ব্রাহ্মণ হয়, কর্ম থেকেই ক্ষত্রিয় হয়, কর্ম থেকেই বৈশ্য হয় এবং কর্ম থেকেই শূদ্র হয়. জন্ম থেকে নয়, কর্ম অর্থাৎ তার কার্য, ব্যবহার, দক্ষতা ইত্যাদি থেকে তার জাতি নির্ধারিত হবে. নহাগবান মহাবীর তার শ্রমণ সংঘে সমস্ত জাতির লোক কে গ্রহণ করেছিলেন। তার শিষ্যদের মধ্যে ইন্দ্রভূতি গৌতম প্রমুখ ব্রাহ্মণ, প্রসেনজিৎ প্রমুখ ক্ষত্রিয়, শালিভদ্র প্রমুখ বৈশ্য এবং হরিকেশবল ইত্যাদি শূদ্ররা স্থান পেয়েছিলেন। তিনি স্ত্রীদের সমুচিত মর্যাদার সাথে শ্রমনী সংঘে দীক্ষিত করেন, চন্দনবালা হয়েছিল তার সাধ্বী প্রমুখা। মহাবীর বলেছিলেন যে চার বর্ণের স্ত্রী -পুরুষ এমনকি নপুংসক ও সম্যক জ্ঞান দর্শন চারিত্র রূপ ত্রিরত্নের সাধনার বলে কেবল জ্ঞান প্রাপ্ত করে, সর্বজ্ঞ হয়ে মোক্ষ প্রাপ্তি করতে পারে অর্থাৎ মানুষই মাত্র ই মুক্তি অর্থাৎ নির্বানের অধিকারী, এর মধ্যে জাতি, বর্ণ , লিঙ্গ ইত্যাদির কোনো ভেদ নেই.
ভগবান মহাবীরের অহিংসার অবধারণ
পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ও বিশেষ ভাবে উপযোগী। মহাবীর ই বিশ্বে একমাত্র যিনি কেবলমাত্র প্রাণীজগৎ নয়, কিন্তু উদ্ভিদের মধ্যেও ও প্রাণ আছে এই কথা তা বলেছিলেন। পরবর্তী কালে বাঙালি বৈজ্ঞানিক জগদীশ চন্দ্র বসু এই কথা তা প্রমান করেন মহাবীরের ২৫০০ বাঁচার পারে। মহাবীরের বিরাট চিন্তন আর ও আগে তিনি মাটি, জল, অগ্নি, এবং বাতাসের মধ্যে ও জীব আছে বলেছেন এবং
উদ্ভিদ, মাটি, জল, বায়ু, এবং অগ্নি এই পাঁচ তত্বের ও হিংসার নিষেধ করেছেন। এই পাঁচ তত্বের সাহায্য ছাড়া জীবন নির্বাহ অসম্ভব সেই জন্য মহাবীর উপদেশ দিলেন এদের যথাসম্ভব সীমিত ব্যবহার। আজকের পরিবেশ সংরক্ষণের এইটাই মূল সিদ্ধান্ত এবং আজকের ব্যবস্থায় Sustainable Development নাম অভিহিত।
সময়ের অতীতের জানলায় উঁকি দিয়ে দেখলে, পেছনে ২৬০০ বছরের ইতিহাস, তৎকালীন মগধ দেশের ক্ষত্রিয়কুন্ড নগরের
রাজা সিদ্ধার্থ এবং মহারানী ত্রিশলার ঘরের আঙ্গনে এক সুন্দর রাজপুত্রের জন্ম দেখতে পাওয়া যাবে। রাজপুত্র হলে হবে কি, সংসারের মনোরম ভোগের প্রতি কোনো রুচি নেই. প্রচন্ড পরাক্রমী এবং দেবদুর্লভ শক্তি থাকা সত্বে ও সে তো
শান্তির পূজারী। হৃদয়ে করুনার ধারা বয়. যৌবন বয়সে
সদা জ্ঞান চিন্তনে সমাধিস্থ। মাত্র ৩০ বছর বয়সে শুধু রাজ্য নয়
সদ্য বিবাহিতা রূপ লাবণ্যময়ী পত্নী যশোদা এবং একমাত্র সদ্যজাত পুত্রী সুদর্শনার মোহ ত্যাগ করে বৈরাগ্য ধারণ করে নির্গ্রন্থ দীক্ষা গ্রহণ করে গৃহত্যাগ করলেন চির শান্তি এবং পরম জ্ঞানের খোঁজে। নিজের হাথে সমস্ত অলংকার ই নয় দেহের বস্ত্র ও ত্যাগ করলেন, আর উপডে দিলেন অপরূপ লাবণ্য যুক্ত নিজের কেশ. তারপর প্রারম্ভ হলো দেশ ভ্রমণ; না কোনো ঘোড়া বা গাড়িতে নয় পায়ে হেঁটে। প্রায় রাত্রিবাস কোনো পাহাড়ের গুহায় অথবা ঘন অরণ্যের মধ্যে কোনো গাছের নীচে, কখনো কখনো কোনো শূন্য গৃহে বা দেবালয়ে। ঘানা জঙ্গলে জীব জন্তুর আক্রমণ হোক বা মশা কামড়ায়; মহাবীর নিজের সাধনায় অবিচলিত।
সাড়ে বার বছরের সাধনায় ঘুমান নি, বসেন ও নি, অতন্দ্রিত ভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের আত্ম সাধনায় নিরত ছিলেন মহাবীর। নিরালস সাধনার বলে রিজুবালিকা নাদির তীরে জৃম্ভিক গ্রামে প্রাপ্ত করলেন দিব্য জ্ঞান অর্থাৎ কেবল জ্ঞান, অজ্ঞানের লেশমাত্র নেই যেখানে, মহাবীর হলেন সর্বজ্ঞ। সর্বজ্ঞ হয়ে নিজের দিব্যজ্ঞানে দেখলেন সংসারের স্বরূপ এবং জগতের দুঃখ দূর করার জন্য উপদেশ প্রারম্ভ হলো.
মগধ থেকে বঙ্গ , গৌড়, কলিঙ্গ, আর উৎকল বেশি দূরে নয়.
বর্তমান পশ্চিম বঙ্গ তার পদযাত্রার সাক্ষী হয়েছিল। জৈন আগমে বর্ণিত হয়েছে যে সাধনা কালে মহাবীর রাঢ় দেশের ও যাত্রা করে তাম্রলিপ্ত বন্দর পর্য্যন্ত এসেছিলেন। বাংলার বর্ধমান এবং বীরভূম জেলা মহাবীরের নাম আজ ও বহন করছে। মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণ (রাঙামাটি) ও আজিমগঞ্জ (তৎকালীন জৈনেশ্বর দিহি) ও হয়েছিল তার পদযাত্রার সাক্ষী। বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান, পুরুলিয়া ইত্যাদি জেলায় আজ ও ছাড়িয়ে আছে অসংখ্য জৈন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।
ভগবান মহাবীরের ১৫০ বছর পরে সমগ্র পূর্ব ভাৱতে ভীষণ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। সেই দুর্ভিক্ষ চলে ১২ বছর পর্য্যন্ত। সেই সংকট সময়ে জৈন সাধুদের কঠিন জীবনচর্যা নির্বাহ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
সেই সময়ে অনেক জৈন সাধুগণ অনশন করে সমাধি গ্রহণ করেন, অনেকে দক্ষিণ ভারতের দিকে প্রয়াণ করেন। সেই সময়ের প্রমুখ আচার্য ভদ্রবাহু পাটলিপুত্রের রাস্তায় নেপাল গিয়ে নিজের সাধনা কে সমর্পিত করলেন। সেই সময় থেকে পূর্ব ভাড়াটে জৈন ধর্মের হ্রাস প্রারম্ভ হয় এবং দক্ষিণ ভারতে প্রাদুর্ভাব।
সেই সময়ের জৈন সাধুদের অভাবে ধর্মাবলম্বীগনের পক্ষে নিজের ধর্মে স্থির থাকা কঠিন হয়ে যায় কিন্তু তারা জৈন ধর্মের মূল আচরণ অহিংসা কে বজায় রাখেন। এই সম্প্রদায় পশ্চিম বঙ্গে সরাক নামে অভিহিত।
সরাক শব্দ জৈন গৃহীদের জন্য প্রযুক্ত
শ্রাবক শব্দের তদ্ভব শব্দ। সরাক জাতির লোকেরা আজ ও বিশাল সংখ্যায় পশ্চিম বাংলার বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ইত্যাদি জেলায় বসবাস করেন।
১৭ ই এপ্রিল ভগবান মহাবীরের জন্ম জয়ন্তী। আজ তার চরণে শ্রদ্ধা সুমন অর্পিত করি.
Jyoti Kothari,